কবি সুরাইয়া শরীফ এর কবিতা, বিজয় দিবস এবং আমার শিশুবেলা
বিজয় দিবস এবং আমার শিশুবেলা
-সুরাইয়া শরিফ
বিজয় দিবস আমাদের অপিতত্বের স্বীকৃতি বিজয় দিবস আমাদের বিশ্বব্যাপী মহান মুক্তিযুদ্ধের বিকৃতি, তিরিশ লক্ষ মানুষের আত্মহুতী, 2 লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময় এবং 1 কোটি মানুষের উদ্বাস্তু হয়ে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় গ্রহণের নামই হচ্ছে 1971 সালের 16 ডিসেম্বর দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা। কারো দানে পাওয়া নয়” আমার বয়স তখন 8 ছুঁই ছুঁই করছে। অন্য শিশুদের মতো আমিও দুরন্তপনায় মাকে জ্বালিয়ে বেড়িয়েছি। শিশু তা নয় আমি ছিলাম খুবই শান্তশিষ্ট এবং পড়াশোনার প্রতি অত্যন্ত আগ্রহী এবং মনোযোগী। আমার মা আমাকে কখনো জ্বালাতনে পড়েননি। বরং পড়াশোনায় মনোযোগী ছিলাম বলে আমার মা আমাকে খুব বেশি ভালোবাসতেন। একাত্তরের 25 মার্চ রাতে মনে পড়ে আমার মা এবং দুই বোন পানি ধরে রেখেছিলাম। আমাদে সাপ্লাই পানির ব্যবস্থা ছিল। সেই pipeline থেকে। কি নাকি পানি থাকবে না অর্থাৎ সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যাবে তাই যত বালতি কলসি এসব ভরে ভরে রাখছিলেন। তারপর পুরো নয়টা মাস ধরে আমরা অন্য একটি পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে কখনো মনিরামপুরে কখনো কাজীপুরের গ্রাম এলাকায় পালিয়ে থেকেছি। এসব জায়গায় অবশ্যই আমাদের আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি। আমার আব্বা পৌরসভা চাকরি করতেন তিনি সচেতন এবং দেশপ্রেমিক ছিলেন। একসময় জালেম মিলিটারিদের ঘোষণার কারণে আব্বাকে অন্য চাকরিজীবীদের সাথে চাকরিতে যোগদান করতে হয়। আব্বা তখন আমাদের সবাইকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন কিন্তু ততদিন আমাদের বাড়ির সব জিনিসপত্র মুরগি গরু সবকিছুই লুট হয়ে যায় আমাদের আর কিছুই নেই বিহারীরা সব লুট করে নিয়ে গেছে। আমাদের বাড়ির সামনা সামনি bihari koloni ছিল। অবস্থায় আমরা এক প্রকার জীবন মৃত্যু হয় ভয়ে-আতঙ্কে বসবাস করতে থাকি। আমার আব্বা ছাপোষা মানুষ চাকরিটা না করলে সন্তানদের মুখে অন্ন তুলে দিতে পারছিলেন না এই যন্ত্রণায় চাকরিতে জয়েন করেন। মুক্তিযুদ্ধ কি তখনও বোঝার বয়স হয়নি অথচ মনে পরমা রুটি বানিয়ে নারকেল দিয়ে কখনো চাল আটা পেয়েছেন তখন মুক্তিযোদ্ধাদের দিতেন। এটা আমাদের শহর ছাড়ার আগে। আবারো দেখেছি বা মনে পড়ে শেলপাড়ার সেই গগনবিদারী শব্দ। কি ভয়ংকর ভুতুরে অন্ধকার। তারমধ্যে মহাশয়ের চিৎকার চেঁচামেচি কান্নাকাটি মা-বাবা সব সময় আমাদের নিয়ে উৎকণ্ঠা এবং উদ্বেগ দিন কাটাতেন। নানা ধরনের ক্ষয়ক্ষতি তার মধ্যে বেঁচে থাকা। স্কুলে যেতে পারতাম না তার জন্য খুব মন খারাপ লাগতো। মনে পড়ে একদিন অনেক বেশি মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল। সেদিন আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে Trunks ঘটনা। আমার আব্বার সহ আমরা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ট্রাংক যাওয়া দেখছিলাম । হঠাৎ একজন মুক্তিযোদ্ধাও ঐ ট্রাঙ্ক থেকে লাফ দিয়ে নেমে এসে আমার আপাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে সেকি কান্না। হাতে রাইফেল চুল দাড়িতে তার চোখ একেবারে ঢেকে গেছে। বড় হয়ে দেখেছি তিনি চাচঁড়া ডালমিল মালিকের ছেলে, আশরাফ চৌধুরী। আমি এখন তাকে শ্রদ্ধা করি একজন গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে। আমি জীবনের একজন মুক্তিযুদ্ধাকে কিভাবে সেই শিশু বেলায় দেখেছিলাম। আর কয়েকদিন পরেই 16 ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। জাতী অত্যন্ত জাঁকজমকের সাথে এই বিজয় দিবস পালন করবে । যে সর্বোপরি সকল পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা আজও বেঁচে আছেন তাদের পরিবারকে সহযোগিতা এবং ওই মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বত্মক শ্রদ্ধা ও সম্মান জানানো এটা জাতি হিসেবে আমাদের একান্ত অপরিহার্য। গত বছরে গ্রামের কাগজ পত্রিকায় দেখেছিলাম একজন মুক্তিযোদ্ধা ভারতে যে ভিক্ষা করে পরিবারের ভরণ-পোষণ চালাচ্ছেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল কেন তিনি ভারতে যে ভিক্ষা করছেন? বলেছিলেন, লজ্জা লাগে তাই। সবই চেনা মানুষ তাই লজ্জা লাগে বলে ভারতে যায়। এর মত মর্মান্তিক আর কিছু হতে পারেনা। মুক্তিযুদ্ধাদের এখনো ভিক্ষা করে খেতে হচ্ছে। আমার কাছে একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী আসেন ভিক্ষা নিতে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আগে যশোর পোস্ট অফিসের চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘদিন বিছানায় পড়ে থেকে মারা গেছেন। জীবনের বিনিময়ে আমরা এই দেশটাকে পেয়েছি তাদের দূরব্যবস্থার জন্য আমরা লজ্জা পায়না। তাহের মাসে সকলেই সংকীর্ণতা ভুলে সকল মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবার সহ সকল অসহায় মানুষদের সেবায় কাজ করি। আবার কয়েকদিন আগে পত্রিকায় পড়লাম একজন মুক্তিযোদ্ধা কে মেরে ফেলা হয়েছে। যারা দেশটাকে স্বাধীন করলো সেই স্বাধীন দেশে বসবাস করে একজন মুক্তিযোদ্ধা কে মেরে ফেলা হয়েছে এর মত দুর্ভাগ্যের আর কি হতে পারে।
No comments